October 3, 2012

গাড়ল গরু


টেক্সাসের আদিগন্ত বিস্তৃতি। ফিরোজা নীল আকাশের বাটিতে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, সোনালি গমের খেত পেকে ঝমঝম করছে। মাঝখান দিয়ে সরু ফিতের মতো সোজা কালো রাস্তা। খেতের সীমানার অন্তে সবুজ রমালের মত টুকরো নরম মাঠ, তার চারধারে সাদা বেড়া। ইতস্ততঃ গরু চরছে, বিখ্যাত "লংহর্ন"

"নেসি" - মধ্যরাত্রিনীল নিসান - বনেটে দুপুরের রোদ্দুর ঝলসিয়ে গড়গড়িয়ে চলেছে। ভেতরে স্বয়ং আমি আর ল্যাংবোট। ভাতঘুমে গাড়ি চালাচ্ছি, একটা ঝিমধরা ব্যাপার।

ল্যাং - কত্ত গরু! হ্যামবার্গার খাব!
আমি - এই তো খেয়ে বেরোলি!
ল্যাং - গরু দেখলেই আমার খিদে পায়।
আমি - তুই নরকে যাবি!
ল্যাং - নাহ, ওটা কলকাতায় খেলে হয়, এখানে অন্য সিস্টেম।
আমি - তোর মতো চোখের-খিদে জনতার জন্যে একটা করে মেশিন দরকার। বড় একটা বাক্স টাইপ। গরু অন্দর, বার্গার বাহার। একদিক দিয়ে গরু ঢুকবে, অন্যদিকে পটাপট বার্গার বেরবে। পাশ দিয়ে শিং খুর ল্যাজ একটা ব্যাগে জমা হবে, আর গ্যালগ্যাল করে রক্ত বেরিয়ে একটা বালতিতে পড়বে।
ল্যাং - ওয়াক ওয়াক। ঠিক আছে, ম্যাকনাগেট খাই তাহলে। গাড়ল গরু সব। আর ঘোড়া তো খাওয়া যায় না। ঘোড়েল ঘোড়া।
আমি - তোর বাংলায় ব্যুৎপত্তি দেখে আমি স্তম্ভিত।
ল্যাং - স্তম্ভিত মানে যেন কি? খুশি হওয়া, না?

আধঘণ্টা পর -দেখছি কোথায় কফি পাওয়া যায়। ল্যাংবোট ঘুমিয়ে পড়েছিল,গাড়ি থামতেই চমকে উঠে বসল (এটা ইংরিজিতে লিখতে হবে) কি হয়েছে? Are you pheeling hejji? And a litil diji?
আমি কিছু হয় নি, কফি কিনব।
ল্যাং তাই বল। আমি ভাবলাম you are going creji, মাঠের মধ্যে গাড়ি থামিয়ে তেল খুঁজবি হয়তো।

আজেবাজে কথা পাত্তা দিলাম না। কফি নিয়ে আবার গড়গড়।

There ij a cool breej on the briz.  ল্যাং ছোট্ট কমেন্ট হাওয়ায় ভাসিয়ে  গুটিসুটি মেরে ঘুমোনোর তোড়জোড় করতে লাগলো। ধারেপাশে যদিও ব্রিজের ব ছিল না।

(জুন, ২০০৮)

October 1, 2012

দিন দুপুরে ...

(বড়মাসি অস্ট্রেলিয়াতে ৪০ বছর কাটিয়ে সদ্য কলকাতা ফিরেছে)

দুপুরবেলা, তীব্র গরম পড়েছে। ফুলস্পিডে পাখা চালিয়ে দিদু আর বড়মাসি খেতে বসেছে। গৌরদা (দিদুর বাজার সরকার/লোকালগার্জেন/অ্যাসিস্ট্যান্ট) পরিবেশন করছে - মুসুর ডাল, আলু-কুমড়ো-সেদ্ধ-নুন-তেল, ভাত, বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল, কাঁচা আমের চাটনি, টক দই।

বড়মাসি বেশ আনন্দে আছে। মিনারেলজল খাচ্ছে না, রেগুলার বাইরে খেয়েও পৈটিক গোলযোগ হয় নি, কলকাতার গরম তাকে কাবু করতে পারে নি। জাহাজে তার অনেক জিনিস আসছে, তার মধ্যে দুটো টেনিস র‍্যাকেট, একটা পাউরুটি-মেশিন আর একটা খাতার কথা আমরা সমানে শুনছি। "সেইবার আমরা ক্রুজে গিয়ে একটা কি দারুণ জিনিস দেখলাম জানিস তো, লাল মত, পেটের কাছটা নীল...দাঁড়া, আমার খাতা আসছে, ওতে সব লেখা আছে" কিম্বা "চাইনিজ রাজকন্যাগুলো কি সুন্দর! সিল্কের ওপর সিল্ক পরেই যাচ্ছে পরেই যাচ্ছে, কোমরে এই মোটা সোনার বেল্ট তাতে নানারকম জেড আর রুবি বসান...ছবিটা আমার খাতায় আছে..."

যাই হোক, দুপুরবেলা বড়ঘরের খাবার টেবিল।

গৌরদা বড়মাসির থালায় ডাল দিতে দিতে বলল "বাড়িটা তো চিড়িয়াখানা বানিয়েছেন ভাল। দুটো গিধনি পাখি নিয়ে আসুন এবার, পায়ে দড়ি বেঁধে দেবেন, ছাদে উড়ে বেড়াবে।"
বড়মাসি উৎসাহিত "গিধনি পাখি কিরে? হাতিবাগানে পাওয়া যায়?"
গৌরদা  সবজান্তা হেসে "কি যে বলেন! ওকি পোষা পাখি? ও থাকে পাহাড় চুড়ায়, জোড়া বেঁধে। একা ওরা বাঁচেনা, আর ধরলেও বাঁচেনা"
বড়মাসি বিভ্রান্ত "এই যে বললি পুষতে? ঠাট্টা করলি বুঝি?"
গৌরদা ক্ষুণ্ণ "না না! আমরা দেশের বাড়িতে ওদের ডাক শুনেছি, এই বড় বড় পাখি! যে সাপের মাথায় মানিক থাকে, সেই সাপ খায় ওরা। সাপের মাথার মানিক জানেন তো? নাকি অশটেলিয়াতে থেকে সব ভুলে গেছেন?
বড়মাসি উত্তেজিত "সাপের মাথায় মানিক? কই আমি দেখিনি তো? সিডনি জুতে অবশ্য সাপের দিকটা আমি বেশি যেতাম না - ওগুলো বড্ড কিরম যেন লাগে - কিন্ত নিকিকে বলতে হবে, ওর এসব হিস্ট্রি জানা দরকার!" (নিকি বড়মাসির নাতি)
গৌরদা খুশি হয়ে "হ্যাঁ, আমি তাই বলছি! সাপ মাথার মানিক রেখে সেই আলোতে পাখিটাখি ধরে খায়। আর গিধনি সেই সাপ খুঁজে বার করে, আর যাদের পোষা হয়, তারা বড়লোক হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজাগজারা খুব বদমাশ, সব মানিকটানিক ওরাই নিয়ে নেয়, গিধনির মালিক কিছু পায় না। গরিবমানুষের কত কষ্ট বলুন। আর এই যে ভোট আসছে, আবার একগাদা মানুষ মরবে, রাজারা আরো বড়লোক হবে। সাধে কি দেশটা সাহেবরা ... "

ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গৌরদা রান্নাঘরে দই আনতে গেল।

বড়মাসি এদিকে মহা চিন্তায় পড়েছে, নিকিকে না জানানো অব্দি শান্তি নেই। " এইসব ফোকটেলের কিছু বই আনিস তো, পম্পি? নিককে পাঠাতে হবে। ও খুব ভালবাসে বই পড়তে, ওর বারো বছর হলে বন্ধুদের নিয়ে এখানে আসবে বলেছে, আমাদের এই বাড়িটা ওর দারুণ পছন্দ। কিন্তু...আমি কোনোদিন গিধনি পাখি... আচ্ছা গৌর ইয়ার্কি মারছে, না? "

দিদু এতক্ষণ এই আষাঢ়ে কথোপকথনে পাত্তা না দিয়ে  মনোযোগসহকারে মিলিকে আমের চাটনি খাওয়াচ্ছিল, হঠাৎ খেয়াল করল বড়মাসি শুকনো হাতে বসে আছে। "রাণু? বসে আছ কেন? পেট ভরেনি বুঝি? আরেকটু চমচম খা। আর ওইসব সাপটাপ আমার ভাল লাগে না, গৌরকে মারব আমি, আজেবাজে কথা বলে মাথা  ধরিয়ে দিল। গৌর? রানুকে চমচম দিয়ে দই দে, আর একটা কথাও বলবি না। যা তুই খেতে বস। রানু, যাও হাত ধুয়ে একটু শুয়ে নাও, অনেক বেলা হল।"

চুরাশি-বছুরে মায়ের আদেশে পঁয়ষট্টি-বছুরে মেয়ে চটপট উঠে হাতমুখ ধুয়ে নাকে চশমা এঁটে সটান ডিভানে শুয়ে "Silk Route" এর পাতায় মগ্ন হয়ে পড়ল। 


(২০০৫, এপ্রিল মাস)

র‍্যান্ডম একদিন

আমার বোন/ধু "চি" মাসছয়েক আমাদের কাছে ছিল, গত বছর। 

এমনিতে ও প্যাঁচা প্যাটার্ন, রাত্রে জেগে থাকে দিনে ঘুমোয়। কাজেই, আমরা যখন আপিস কাছারি শেষ করে রাম-টায়ার্ড অবস্থায়ে টিভির সামনে জিরোতে বসি, তখন ওর রাজ্যের এনার্জিতে ফুটকড়াই অবস্থা। এই আলু-ফুলকপি রান্না করে ফেলছে, এই চেলো কাবাব বানাচ্ছে, এই গাদা কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে মায় ভাঁজ পর্যন্ত করে ফেলছে - অভ্যেস এমন খারাপ করে দিল যে ও ফিরে যাওয়ার পর ওই ভাঁজ করা কাপড়ের লোভে বাড়ির সামনে কিউবান ধোপাকে কাপড় দেওয়া শুরু করলাম - যদিও তার নাম জাফর। আর রান্নাঘরে মশলার তাকে এলাচ-লবঙ্গ-দারচিনি-লঙ্কা-হলুদ-তেজপাতা-জিরে ছাড়া যে এক গন্ডা কৌটো আছে, সেগুলো আমি চিনিও না, ব্যবহারও করি না।

সে যাক গে। এমনি একদিন, খুব বৃষ্টি পড়ছে। 

বৃষ্টি পড়লে মনটা যুগপৎ ভালও হয়, খারাপও হয়। সেই দোলাচলে মুড়ি পেঁয়াজি চা ব্যাপারটা জমবে ভালো। এদিকে সূর্য আজ ওঠেনি বলেই বোধহয় - ডাক্তারবাবু সন্ধ্যের মুখে বাড়ি চলে এসেছেন। পেঁয়াজ ব্যাসন লঙ্কা নুন গুলে, চা বানিয়ে, "চি" কে ডাকতে গেলাম। 

আমি - উঠে পড় উঠে পড়, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
"চি"  সোফাতে ঘুমন্ত।
আমি - কিরে, উঠবি না?
"চি" তাও ঘুমন্ত।
আমি মৃদু ঠেলা দিয়ে - এই, ওঠ!
"চি" মাছি মারার মতো করে আমার হাতে এক চাপড়
আমি - আহ! মারছিস কেন? 
"চি" ঘুমন্ত অবস্থায় - মজা 
আমি - মজা? বার করছি তোর মজা (কাতুকুতু দেওন)
"চি" - উঁ উঁ ...বলছি আমি কাজটা শেষ করেই আসছি 
আমি - এখনি ওঠ, এক্ষুনি 
"চি" - বাড়ি চলে গেছে
আমি - কেউ বাড়ি যায় নি, পেঁয়াজি বানাচ্ছি খাবি চল 
("চি" হাঁ করে অপেক্ষা করন )
আমি - এখানে দেব না, খাবার টেবিলে চল 
"চি" পাশ ফিরে - আচ্ছা, কাল যাব।

সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না দেখে, ঘরের সব আলো জ্বেলে জোরসে এক ঠেলা মারলাম - আধখানা লাল চোখ খুলে গেল - সকাল হয়ে গেছে?
আমি ঘটঘট করে জানলা বন্ধ করতে করতে - সকাল সেই সকালে হয়েছিল, এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আর তুই আমাকে মেরেছিস।
"চি" ভোম্বল অবস্থায় - মেরেছি? কেন? 
আমি ভিকটিম মুখে - কেন আমি কি জানি? আমি তোকে পেঁয়াজি খেতে ডাকতে এলাম ..." 
"চি" করুণমুখে - ইস সরি সরি। ঘুমের মধ্যে আমি বুঝতেই পারি না ..." 

এর পর আমায় পেঁয়াজিও ভাজতে হলো না, চাও করতে হলো না। রাত্রে উত্কৃষ্ট খিচুড়ি রান্না হলো, সাথে ডিমভাজা আর পাঁপড়।

এখন বৃষ্টি পড়লে ম্যাগি বানাই আর ডাক্তারবাবু হা-হুতাশ করেন।

(জুলাই, ২০১১)

এতদ্দ্বারা "চি" কে সত্বর ফিরিয়া আসিতে অনুরোধ করা হইতেছে