September 27, 2012

ঝটিকা সফর - ১


সাত দিনের জন্যে কলকাতা ঘুরে এলাম। মাথার মধ্যে প্ল্যানটা ঘুরপাক খাচ্ছিল কদিন ধরে, তারপর টিকিট করে প্রদীপ্তকে casually বললাম আমি কলকাতা যাচ্ছি (যেমন মাঝে মধ্যেই অস্টিন যাই, এমন একটা ভাব)। শুনে বিমর্ষ হয়ে ফুচকা খেতে মানা করল, কিন্তু কবে যাচ্ছি কবে ফিরছি সেসব আর জিজ্ঞেস করল না। আমিই ফড়ফড় করে বললাম এই দিন airport পৌঁছতে হবে এই দিন আনতে হবে ইত্যাদি। মা কে সারপ্রাইজ দেব, এই প্ল্যান।

মায়ামি থেকে নিউ ইয়র্ক হয়ে দুবাই পৌঁছে মাকে sms করলাম আমি একটা সেমিনারে খুব ব্যাস্ত আছি, ফোন করতে পারছি না। মা উত্তর দিল "ঠিক মত খেয়ে নিস"।
এই খাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে এত ইয়ে... যাকগে, কথা না বাড়িয়ে আমি চকোলেট কিনতে গেলাম।

কলকাতা পৌঁছে দেখি ফোনটা কাজ করছে না। বিরক্তিকর ব্যাপার, তারপর সুটকেসও আসছে না। ইতি উতি ঘুরছি আর ভাবছি কেন এত দেরি - হঠাৎ শুনি আমার নাম ঘোষণা করছে। (নিউ ইয়র্কেও গমগমে স্পিকারে বিকৃত উচ্চারণে আমাকে ডাকাডাকি করা হচ্ছিল, কারণ আরেকটু হলে প্লেন মিস করছিলাম)। তো স্যুটপরিহিত চিমসেপানা এক ছোকরা আমাকে সবিনয়ে জানাল যে আমার সুটকেস আসে নি। আমি যত বাংলা বলি সে তত ইংরিজি বলে। তারপর গুচ্ছের ফর্ম ধরিয়ে ভরতি করতে দেয়, যেন দোষটা আমারি। ঝাড়া আধ ঘণ্টা লাগলো সেই baggage report তৈরি করতে, তারপর তারা বড় সাহেবের কাছে সই করাতে গেল। আমি এর মধ্যে গটগট করে বেরিয়ে বনি /  ভোঁদুকে বলতে গেলাম কেন আমার দেরি হচ্ছে । ফেরার সময় পুলিশদাদা আটকাতে গিয়ে বেজায় ধমক খেল। খিদে পেয়েছে, ঘুম পেয়েছে, সুটকেস আসে নি, এই সময় ধাষ্টামো ?

বাড়ি পৌঁছে বনিদের একটু পেছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। মা গেট বন্ধ করতে যাচ্ছিল, আমাকে দেখে কির'ম যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। তারপর তড়বড় করে "একি? তুই এসেছিস? এরম তো কথা ছিল না? কি ব্যাপার? কি কাণ্ড! কি মজা!!" ইত্যাদি নানা সব বলতে লাগলো। তারপর পিঙ্গুকে অনেক আদর করল, বনির পিঠে হাত বোলাল, আর উত্তেজিত হয়ে এঘর ওঘর করতে লাগলো।

আমি এদিক ওদিক ওপর নিচ দৌড়ে সবাইকে জানিয়ে এলাম আমার আগমন বার্তা। চিরন্তন ফিতে হাতে মামী এসে হাজির, মামা ক্রসওয়ার্ড এর কাগজ শুদ্ধু উঠে এসেছে, পিঙ্গু নেচে কেঁদে একসা করছে, দিদু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে -  বাড়িতে প্রচন্ড হট্টগোল শুরু হোল। তার মধ্যে মায়ের স্রোতের মত প্রশ্ন " গিজার চালাবো? কোথায় ঘুমোবি, তিনতলায় নাকি এখানে? চা খাবি? ইস কি কান্ড! কবে বেরিয়েছিস? সেমিনারটা গুল ছিল?? বনি সব জানত কিন্তু আমায় কিছু বলে নি? হিইইইইইই!! "

পিঙ্গু এদিকে দিশেহারা হয়ে একবার বড় খাট একবার ডিভান লাফ দিচ্ছিল, কোঁওওও কুঁউউঁউঁ নানারকম আওয়াজ করে। তারপর একদম velcro হয়ে গদগদ মুখ করে হাত/গলা/মুখ চেটেই চলল, আর ক্ষণে ক্ষণে handshake করল (পিঙ্গু ভয় পেলে, অথবা প্রচন্ড আনন্দিত হলে হাসি/কান্না মুখে handshake করে)। তারপর পেছন পেছন দৌড়তে লাগলো ওপর নিচ, আমার সঙ্গে বাথরুমেও ঢুকে গেছিল। মা যখন তাকে খাওয়াতে বসাল, মাঝে মাঝেই ঘাড় কাত করে দেখে নিচ্ছিল আমরা ঘরে আছি কিনা, একবার ঝোল-মাখা মুখে এসে ঢুঁসিয়ে গেল। সেদিন রাত্রে গরম লাগা সত্ত্বেও বড় খাটে আমাদের মধ্যে শুল, আর ঘুমের মধ্যে কিরম যেন সাঁতার কাটার মত করছিল। 

সুটকেস নেই, চানটান করে বনির পাজামা আর টি শার্ট পরে ফোন করলাম। "দিদি? আমি এসে গেছি, তুই কাল আয় শিগগির (তুই কি সত্যি পাগল পম, ডেলি প্যাসেঞ্জার নাকি?) ঝুম? হাহাহা ইয়েস আমি আবার চলে এসেছি (এটা তুইই পারিস...সোনামাসি কতায়? কতায়?) ভিক্স!! আরে এটা আমি - নতুন নম্বর কারন পুরনো সিমটা ভোঁদাফোন নারায়ণ করে দিয়েছে (তুই যে কেন ফেরত যাস সেটাই আমি বুঝি না...দিদিভাই এসেছ? ভেরি গুড - এটা বুবুন) তারপর প্রদীপ্ত কে একটা মেসেজ করে দিলাম, দিনের বেলা ফোনে কথা বলার সময় দেন না Dr. Rosenberg"...যাকে সবাই "Lion King" বলে ডাকে...

ওদিকে মা জনে জনে ফোন করে খবর দিচ্ছে - "ঠাকুরপো? কেমন আছ? হাঁটু ব্যথা কমেছে? মা ভাল আছেন...এই ত...আজ  কি হোল বল তো? একটু আগে মাম্পু এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ!! আমি তো কিছুই জানি না, তকাই বলল ইলিশ মাছের ঝোল করে রাখ আর কফি কাস্টার্ড, আমি ভেবেছি শনিবার বলে বোধয়...তারপর দেখি সিঁড়ি দিয়ে "হ্যালো মা" বলে উঠছে। আমি যে তখন কি করব কি বলব ভেবেই পাচ্ছি না...  মাথা গুলিয়ে গেছে...হ্যাঁ সাত দিন মাত্র সময়, রাত্তির জেগে অফিস করবে..."
"টুকা? কি করছিস? না এখন খাব কি, সবে এগারটা বাজল। আজ কি হয়েছে বল তো? একটু আগে মাম্পু এসে পৌঁছেছে......(বাকিটা আর লিখলাম না)
" অমুক? কেমন আছ? আজ কি হয়েছে বল তো?" ইত্যাদি

খেতে বসতে বসতে রাত্তির পৌনে একটা বাজল। বনি মেথি চিকেন বানিয়েছিল - দারুণ খেতে হয় সেটা - আর মা করেছিল ইলিশ মাছ। খেতে খেতে কথা হচ্ছে মাছের কত দাম কি বৃত্তান্ত..মা বলল ইলিশ মাছ তো আমার পথ্য, ডাক্তার খেতে বলেছে ওমেগা থ্রি আছে বলে, কিন্তু যা দাম - রোজ কি আর খাওয়া যায়? বনি খুব গম্ভীর হয়ে বলল "তাহলে কাল থেকে ওমেগা থ্রি ক্যাপসুল দিয়ে পাঁচ ফোড়নের ঝোল বানিও"।

এঁটো হাতে আড্ডা মারছি, দেড়টা বাজে - মামা এসে পড়ল। হাতে একটা বাটি। পেছনে চিরুনি হাতে মামী।
আমি - একি মামা এখন খাও নি?
মামা (ব্যাজার মুখে) - না আর কি খাব, বিকেলে মামী এমন এক ধামা মুড়ি বাদাম দিয়েছে, পেট ঢাই হয়ে আছে...
মামী (বিস্মিত) - এক ধামা? এইটুকু বাটিতে মুড়ি দিলাম তো, আর তুমিই চাইলে...
আমি (কাজিয়াটা আটকে) বাটিতে কি?
মামা - এটা হোল চিংড়ি মাছ, খেয়ে নে।
আমি - এখন তো মিষ্টি খেয়ে ফেললাম, কাল খাব নাহয়?
মামা - এটাও মিষ্টি, ওনলি গোলমরিচ আর বাতাবিলেবু দেওয়া।
আমি (হাঁ করে) - বাতাবিলেবু?
মামী - দেখ না আমি বলেছিলাম একটা রেসিপি পেয়েছি, অমনি রান্নাঘরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল - আচ্ছা কাল খাস।
মামা - ঠিক হ্যায়, সামনের সপ্তাহে বিরিয়ানি করব নাহয়, আর স্লাইট ভেটকি ফীলে।

আমরা সমবেত কণ্ঠে আনন্দ প্রকাশ করলাম। নানা আড্ডা হাহা হিহি চলল ভোর রাত্তির অব্দি। শুতে যাওয়ার সময় শুনি কাক ডাকছে। আহ! কদ্দিন পর কাকের ডাক! 

2 comments:

  1. বাড়ি পৌঁছে বনিদের একটু পেছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। মা গেট বন্ধ করতে যাচ্ছিল, আমাকে দেখে কির'ম যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। তারপর তড়বড় করে "একি? তুই এসেছিস? এরম তো কথা ছিল না? কি ব্যাপার? কি কাণ্ড! কি মজা!!" ইত্যাদি নানা সব বলতে লাগলো। তারপর পিঙ্গুকে অনেক আদর করল, বনির পিঠে হাত বোলাল, আর উত্তেজিত হয়ে এঘর ওঘর করতে লাগলো।

    - এই জায়গাটা অসাধারণ।

    ReplyDelete

Leave a comment